মুদ্রিত বই বনাম ই-বুক


"বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।।"

                                                                                                                                         -শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কবির এই উক্তি সত্যিই যথার্থ। বইয়ের গুরুত্ব আমাদের জীবনে কতটা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাহিত্যপ্রেমী কিংবা জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে বই স্বর্গ স্বরূপ। বইয়ের মাধ্যমে আমরা কত জায়গায় না পৌঁছাতে পারি, দুর্গম পর্বতরাজ হিমালয় কিংবা সুদূর নর্থপোল, ঐতিহাসিক ডাইনোসরের যুগ বা কল্পনার জগতের পরীদের দেশ। সবকিছুই সম্ভব বইয়ের দ্বারা। বই যেমন আমাদের কল্পনার জগতে ভাসতে সাহায্য করে তেমনি আবার বিজ্ঞানমনস্ক সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।

যত দিন গেছে মানুষের জ্ঞানের চাহিদা বেড়েছে । চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ উদ্ভাবন করেছে নতুন নতুন যন্ত্রপাতির , নতুন নতুন জিনিসপত্রের , যার কোনো কোনোটা সত্যি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। মোবাইল, কম্পিউটার , দূরদর্শন প্রভৃতির মতো বৈদ্যুতিক মাধ্যম বর্তমানে জ্ঞানার্জনের জন্য বহুলভাবে ব্যবহৃত । ইন্টারনেট আসার পর এখনতো সারা বিশ্বের জ্ঞান মোবাইল স্পর্শ করে বা কম্পিউটারের একটি বোতাম টিপে জানা সম্ভব।

 মানুষ এখন তার বই পড়াটাকেও অনেক সহজ করে নিয়েছে । ভারি-ভারি , বড়-বড় বই এখন কোথাও বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনই হয়না। বর্তমান সময় ই-বুক , ই-ম্যাগাজিন ব্যাপকভাবে চিরাচরিত মুদ্রিত বইয়ের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে যেমন কাগজের সাশ্রয় হচ্ছে তেমনি সাশ্রয় হচ্ছে শ্রমেরও । শুধুমাত্র একটি মোবাইল বা কম্পিউটার থাকলে তাতে সহজেই ই-বুক রাখা সম্ভব। ই-বুক আসার পরে ব্যাপক ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও । মানুষ স্বভাবতই সব সময় সহজ পথ অবলম্বন করে সময় এবং শ্রমের সাশ্রয় করতে চায় । আর ই-বুক অসাধারণ ভাবে মানুষের সময় এবং শ্রম সাশ্রয় করতে সক্ষম।

 ই-বুক ব্যবহারের অনেক সুবিধা রয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের সকলেই প্রায় ই-বুক ব্যবহার করে থাকেন। সাধারণ মুদ্রিত বইয়ের থেকে অনেক ভালো এবং সহজভাবে ই-বুক পরিচালনা করা সম্ভব। সাধারণ বই ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে কিন্তু ই-বুকের তেমন কোন ব্যাপারই নেই! যুগ-যুগান্তর ধরে ই-বুক রাখা যায় তা ছিঁড়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোন ভয় থাকে না । সাধারণ বই তৈরি করার জন্য অনেক কাগজের প্রয়োজন কিন্তু ই-বুক তৈরি করার জন্য কোন প্রকার কাগজ বা কালির প্রয়োজন হয়না, প্রয়োজন হয়না কোন প্রকার ছাপাখানার। ই-বুক সাধারণ বইয়ের তুলনায় অনেক কম ব্যয়বহুল এবং সহজলভ্য । সর্বোপরি ই-বুক আনার জন্য কোথাও যেতে হয় না মোবাইল বা কম্পিউটারের সাহায্যে ইন্টারনেটের দ্বারা অতি সহজেই ডাউনলোড করা সম্ভব। ই-বুক ব্যবহারের ফলে মুদ্রণের খরচ ও বাঁচে। এক কথায় বলতে গেলে ই-বুক বর্তমান ব্যস্ত জনজীবনের কাছে উপহার স্বরূপ।

তবে ই-বুক ব্যবহারের যেমন সুবিধা রয়েছে তেমন কিছু অসুবিধা ও রয়েছে । যাদের কাছে মোবাইল বা কম্পিউটার নেই তারা ই-বুক ব্যবহার করতে অক্ষম কারণ ই-বুক একমাত্র মোবাইল বা কম্পিউটার এর দ্বারাই পরিচালনা করা সম্ভব। মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি তাই সকলের কাছে তা উপলব্ধ থাকে না , আর যে সমস্ত মানুষ মোবাইল বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানেন না তাদের পক্ষে ই-বুক ব্যবহার করা সম্ভব নয়। যাদের চোখের সমস্যা তারা ই-বুক পড়ার সময় অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন।

ই-বুক বহুলভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ফলে সাধারণ মুদ্রিত বইয়ের চাহিদা অনেকটা কমে গেছে এর ফলে যারা বই মুদ্রায়ন বা বই বিক্রির মত পেশার সাথে যুক্ত সে সমস্ত মানুষের রোজগার আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। মোবাইল বা কম্পিউটার এর মাধ্যমে প্রায় সকল প্রকার ই-বুক অতি সহজেই ডাউনলোড করে তা পড়া সম্ভব- এর ফলে মানুষের গ্রন্থাগার যাওয়ার প্রতি আগ্রহ ও অনেকটা কমে গেছে।

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের যেমন অনেক সুবিধা হচ্ছে ঠিক তেমনি হচ্ছে অনেক অসুবিধাও। সময় এবং শ্রম সাশ্রয় করতে গিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন বহু মানুষ ঠিক যেমন ই-বুক আবিষ্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মুদ্রণ শিল্প।

 ই-বুক ব্যবহারের যেমন কিছু খারাপ দিক রয়েছে তার সাথে ভালো দিকও রয়েছে বিপুল। ই-বুক মুদ্রিত বইয়ের বিকল্প হিসেবে বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও মানব মনে মুদ্রিত বইয়ের স্থান সর্বদাই অন্য মাত্রায় । আজও কলেজ স্ট্রিট চত্বরে বইয়ের জন্য ভিড় জমায় হাজার হাজার মানুষ। কোথাও বইমেলা হলে আমরা সকলে ছুটে যাই। জ্ঞানের খিদে পূর্ণ করার জন্য ই-বুক বা মুদ্রিত বই যে রূপেই বই পাওয়া যাক না কেন মানুষের কাছে বইয়ের দাম আলাদাই থাকবে।

- শুভজিৎ পর্বত

কলকাতা।